ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ড. মোঃ আব্দুস ছামাদ,অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ( DUMAA)
পূর্ব বঙ্গের বাংলা ভাষাভাষি মানুষের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের দাবী। এ দাবীর প্রেক্ষিতে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯২১ সালে কলা ও বিজ্ঞান অনুষদের কয়েকটি বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজ্ঞান অনুষদ যে তিনটি বিভাগের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে গণিত বিভাগ তার অন্যতম। উপমাহাশের প্রখ্যাত গণিতবিদ ভ’পতিমহন সেন ও ড. নলিনীমোহন বসুর নেতৃত্বে ৫ জন শিক্ষক নিয়ে গণিত বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে পূর্ব বাংলা সরকারের সেক্রেটারিয়েট ভবনের কক্ষে এবং কিছু কাল কার্জন হলের পশ্চিম পার্শের দোতলায় গণিত বিভাগ অবস্থিত ছিল। সর্ব শেষে ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সায়েন্স এনেক্স-বর্তমানে কাজী মোতাহার হোসনে ভবনের তিন তলায় গণিত বিভাগের অবস্থান। তিন বৎসরের B.Sc সম্মান ও এক বৎসরের M.Sc প্রোগ্রামের মাধ্যমে গণিত বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। তাছাড়া B.Sc পাস কোর্স সম্পন্নকারী ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য এক বৎসরের M.Sc প্রিলিমিনারী কোর্স অন্তর্ভূক্ত করা হয় যা নব্বই দশকের শুরু পর্যন্ত বজায় থাকে।
সত্তর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত গণিতের আটটি বিষয় অনার্সে অন্তর্ভূক্ত করা হয় যার চুড়ান্ত পরীক্ষা সম্পন্ন হত তৃতীয় বর্ষ শেষে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনার্স প্রোগ্রামকে ছয়টি টার্মে ভাগ করা হয় এবং প্রতি টার্ম শেষে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত। এই পদ্ধতি ১৯৮২/৮৩ শিক্ষা বর্ষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৯৮৩/৮৪ শিক্ষা বর্ষ থেকে অনার্স প্রোগ্রামকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি ভাগকে এক একটি একাডেমিক ক্যালেন্ডারের আওতায় আনা হয় এবং প্রতি বর্ষ শেষে চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য এ পর্যন্ত গণিত (সম্মান) বিষয়ের পাশাপাশি সাবসিডিয়ারী বিষয়ও অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯৯৪/৯৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে সমন্বিত অনার্স কোর্স চালু করা হয় এবং সাবসিডিয়ারী বিষয়ের পরিবর্তে মাইনর কোর্স চালু করা হয় এবং অনার্সেও ফলাফল নির্ণয়ে সমস্ত বিষয়কে সমভাবে গুরুত্ব দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, এই সময়ে বিজ্ঞান অনুষদের অন্যান্য বিষয়ের মত গণিত বিষয়ে ঈড়সঢ়ঁঃবৎ ইধংবফ ব্যবহারিক কোর্স চালু করা হয়। ফলশ্রতিতে স্কুল কলেজেও এখন গণিতের ব্যবাহারিক কোর্স চালু করা সম্ভব হয়েছে।
১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে এ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন আনা হয়। এ শিক্ষা বর্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ৪ বৎসরের অনার্স কোর্স চালু করা হয় যার পরিসমাপ্তি ঘটে এক বৎসরের মাষ্টার্সের মাধ্যমে। এই চার বৎসরে অনার্স ও মাইনর সহ মোট ৩২ ইউনিট কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে “চতুর্থ বর্ষে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে এক ইউনিটের অনার্স প্রজেক্ট” সম্পন্ন করার নিয়ম চালু করা হয় যা এখনও পর্যন্ত চালু আছে। বর্তমানে আবারও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। গণিত বিষয়ের একজন শিক্ষার্থীকে মোট ১৩২ ক্রেডিট কোর্স সম্পন্ন করতে হয় যার মধ্যে গণিতের বিভিন্ন বিষয়ে গধলড়ৎ পড়ৎঁংব হিসেবে ১১৪ ক্রেডিট এবং গরহড়ৎ পড়ৎঁংব (পরিসংখ্যান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান/অর্থনীতি) হিসেবে ১৮ ক্রেডিট মিলিয়ে মোট ১৩২ ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হয়।
গণিত বিভাগ শুরু থেকেই বিশুদ্ধ গণিত ও ফলিত গণিত এর উপর M.Sc ডিগ্রী দিয়ে আসছে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গণিতের উভয় শাখায় গবেষণা ভিত্তিক মাস্টার্স কোর্স প্রবর্তন করা হয় যা থিসিস গ্রæপ নাম সমধিক পরিচিত। বর্তমানে ‘থিসিস’ ও ‘নন থিসিস’ গ্রæপ নামে বিশুদ্ধ ও ফলিত গণিতের এক বৎসরের মাষ্টার্স কোর্স চালু আছে। একইভাবে সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে গবেষণা ভিত্তিক গ.চযরষ প্রোগ্রাম চালু করা হয়। বর্তমানে গ.চযরষ ও চয.উ প্রোগ্রাম গণিত বিভাগে নিয়মিত ভাবে চালু আছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী উল্লিখিত প্রোগ্রাম সমূহে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান অনুষদ ভূক্ত অন্যান্য বিষয়ের কয়েকশত ছাত্র-ছাত্রীকে মাইনর কোর্সের মাধ্যমে গণিত শিক্ষা দিয়ে আসছে। গবেষণা কার্যক্রম গণিত বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ দেশ ও বিদেশের নামকরা জার্নাল ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে যা গণিত বিভাগ তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে। গণিত বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রথম তিনদশক গবেষণা মূলত Mechanics, Fluid Dynamics, Differential and Intrigrel Equations, Number Theory, Mathematical Physics এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে গণিত বিভাগরে কার্যক্রমও এখন বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে। উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে Fluid Mechanics, Fuzzy Mathematics, Operations Research, Theory of Relativity, Numerical Analysis, Functional Analysis, Mathematical Hydrology, Aerodynamics Mathematical Biology, Dynamical Systems, Theory of Groups, Theory of Rings and Modules, Complex Analysis, Lie Groups and Lie Algebras, Geometry of Differntial Manifolds, Asymptotic and Perturbation Theory, Riemannian Geometry, Operations Management ইত্যাদি। বিগত কয়েক বৎসরের মধ্যে উপরোক্ত বিষয় সমূহের উপর বেশ কয়েকজন গবেষককে গ.চযরষ ও চয.উ ডিগ্রী প্রদান করা হয়েছে।
দেশে গণিতের কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে গণিত বিভাগে “বাংলাদেশ গণিত সমিতি’ গঠন করা হয়। এই বিভাগ বিগত বছরগুলোতে বেশ কয়েক বার গণিত সমিতির সহায়তায় অত্যন্ত সুনামের সংগে আন্তর্জাতিক গণিত সম্মেলন সম্পন্ন করেছে। গণিত বিভাগের যাত্রা শুরু হয় একজন অধ্যাপক, দুইজন রিডার, তিনজন প্রভাষক এবং একজন সহকারী প্রভাষক সমন্বয়ে। ১৯২১-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গণিত বিভাগের সুপরিচিত শিক্ষাকদের মধ্যে অধ্যাপক বি.এম.সেন, অধ্যাপক নলিনী মোহন বসু, ড. জ্যোতির্ময় ঘোষ, ড. দূর্গাদাস বন্দোপধ্যায়, ড. মুসফিকুর রহমান, ড. আতাউল হাকিম উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ এবং তৎপরবর্তী যে সব স্বনামধন্য শিক্ষক গণিত বিভাগে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আছেন ড. এম. পিনেল (জার্মানী) , অধ্যাপক আজিজুর রহমান খলীফা, অধ্যাপক ড. এস.এম. আজিজুল হক, অধ্যাপক ড. এম রমজান আলী সরদার, অধ্যাপক এম শামসুল হক, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক আ.ফ.ম আব্দুর রহমান, ড. খোশ মোহাম্মদ, অধ্যাপক এম. সফর আলী, অধ্যাপক এম. শামসুল হক মোল্লা, অধ্যাপক আ.ম.ম শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আ.ফ.ম খোদাদাদ খান, অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক মুনিবুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মিসেস ফরিদা বানু, অধ্যাপক মিসেস ফাতেমা চৌধুরী,অধ্যাপক মিসেস যোবেদা আক্তার, অধ্যাপক ড. টি. এম. জি. আহসান উল্লাহ, অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল কুদ্দুস, অধ্যাপক ড. হাসনা বানু প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ এবং গণিত বিভাগ ঃ
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গণিত বিভাগের সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অংশ গ্রহন করে। বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক এম. সরাফত আলীকে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী সৈন্যরা নৃশংষ ভাবে হত্যা করে এবং অধ্যাপক আ.ম.ম. শহীদুল্লাহকে আর্মি ক্যাম্পে অন্তরীন করে রাখে। গণিত বিভাগের অধ্যাপক সরাফত আলীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে “শহীদ সরাফত আলী কাউন্সিল রুম” নামে গণিত বিভাগের মিটিং রুমের নামকরণ করা হয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন ও পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে বিভাগে যোগদান করেন তাঁরা হচ্ছেন ঃ অধ্যাপক ড. মোঃ নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. মোঃ মোবারক হোসেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অনেক ছাত্র যুদ্ধে শহীদ হন্ তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গণিত বিভাগ তাদের একজনের নামে গণিত বিভাগের পাঠাগারটি নামকরণ করে “শহীদ আজিম স্মৃতি পাঠাগার”।
গণিত বিভাগ এবং এ.এফ.মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন ঃ
এ.এফ.মুজিবুর রহমান ছিলেন এ দেশের একজন প্রখ্যাত গণিতবিদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ছাত্র হিসাবে স্যার আশুতোশ মুখার্জীর রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নামে বর্তমানে এ.এফ.মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। গণিতের ছাত্র হিসাবে উত্তরসুরীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগকে নানারকম সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। তাঁর নামে এ.এফ.মুজিবুর রহমান স্বর্ণপদক চালু করা হয়েছে যা গণিতের মেধাবী শিক্ষার্থীরাই পেয়ে থাকে। এতে গণিতের প্রতি ছাত্র/ছাত্রীদের আগ্রহ বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি উক্ত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা গণিত ভবন তৈরির কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। উক্ত ভবনের নাম হবে “এ.এফ.মুজিবুর রহমান গণিত ভবন” যা সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। উক্ত ভবন সম্পন্ন হলে গণিত বিভাগ থেকে ‘বিশুদ্ধ গণিত’ ও ‘ফলিত গণিত’ নামে দুইটি স্বতন্ত্র বিভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এতে গণিতের আরও বেশী দ্বার উন্মুক্ত হবে, নতুন নতুন ক্ষেত্রে গবেষণার দ্বার খুলে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে অধ্যয়ন শেষে যে সব গণিতবিদগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণিত শিক্ষা ও গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেসব প্রতিথযষা গণিতবিদদের মধ্যে সেতু বন্ধনের জন্য সম্প্রতি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ( DUMAA)” গঠিত হয়েছে। আশা করা যায় এই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত গণিতবিদদের মধ্যে গণিতের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত ও গবেষণার দ্বার উন্মোক্ত হবে। সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা লগ্ন থেকে যারা এই বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন তাঁদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হবে এবং সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পাবে।